একজন দেশপ্রেমিক মানবিক রাজনীতিকের জন্য শুভকামনা

  |  Tuesday, January 12th, 2021 |  12:23 am

লেখক: মোহাম্মদ নুরখান

দপ্তর সম্পাদক, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ (প্রস্তাবিত কমিটি)

রাজনীতি- মানুষের জন্য করার, মানুষের ভালবাসা পাবার অন্যতম একটি মাধ্যম। এ রাজনীতিকে আমরা কেউ কেউ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য আবার কেউ কেউ উপড়ে উঠার একমাত্র সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে থাকি । আবার অনেকেই রাজনীতির মায়াজালে পড়ে মানুষের সেবায়,দেশের কল্যাণে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিই।

মানুষের সেবায় নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া প্রচারবিমুখ এ রকম একজন মানবিক রাজনীতিক চট্টগ্রামের অভিভাবক হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এর আগে তিনি অনেক সময় ধরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন ।

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান লাহোর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি ৬ দফা আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। পূর্ব পাকিস্তানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁর পিতা মরহুম এস রহমান ছিলেন তৎকালীন স্বতন্ত্র এমপিএ। পারিবারিক সূত্রে ছাত্রাবস্থা থেকেই তার মনে রাজনীতি আর সেবার যে বীজ বপন হয়েছিল ক্ষণিকের জন্যও তা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। লেখাপড়া শেষ করে স্বধামে ফিরেই জড়িয়ে গেলেন রাজনীতিতে।

৭০ এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার সফরে আসলেন । তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্মানে তার হোটেল সাইমনে নৈশ ভোজের আয়োজন করলেন।পাশে বসেই বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ালেন সেদিন তিনি। ৭০ এর নির্বাচনে তিনি এমপিএ নির্বাচিত হন।ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। একজন এমপিএ হয়েও সিইনসি স্পেশাল ট্রেনিং গ্রহন করে দেশের ভেতরে ঢুকে যুদ্ধে অংশ নেন , নেতৃত্ব দেন বহু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মীরসরাই’র শুভপুর ব্রীজে অগ্নিসংযোগ করে যান চলাচলের অনুপযোগী করা ছিল সে মুহূর্তে তার বীরত্বপূর্ণ এক সময়োচিত সিদ্ধান্ত। এর ফলে ব্রিজটি চলাচল উপযোগী করে এবং মহাসড়কের ব্যারিকেড সরিয়ে কুমিল্লা থেকে রওনা হওয়া পাকিস্তানী সৈন্যবাহী ২৬টি সাঁজোয়া যানের চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল ।যার কারণে এই এক সপ্তাহ চট্টগ্রাম মুক্ত ছিল ।


মীরসরাইর অছি মিয়া ব্রীজ, সীতাকুণ্ডের ইস্টার্ন কেমিক্যালের পাশের ব্রীজ ধ্বংস এবং সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।পরিকল্পনা করলেন ইস্টার্ন রিফাইনারি ধ্বংসের ।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।ক্যাম্পের কেউ সাহস করলেন না এ দায়িত্ব নিতে । কারণ পুরো অপারেশনটি ছিল আত্মঘাতিমূলক।কিন্তু যার কাছে সর্বাগ্রে দেশ মৃত্যু বা অন্য কিছু তার কাছে তুচ্ছ।অমিত সাহসী মোশাররফ হোসেন ৬.৫ ফুট দীর্ঘ আরসিএল গান নিয়ে বর্ষার কর্দমাক্ত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে দেশের ভেতরে ঢুকে চট্টগ্রামের কাজির দেউরীতে নির্দিষ্ট শেল্টারে আশ্রয় নিলেন। এ যেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।ইস্টার্ন রিফাইনারি এলাকায় গিয়ে ছক আঁকলেন আক্রমণের।পরদিন অন্য সাথীদের নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন শেল্টারে বসে ।মুহূর্তেই শুরু হলো শেল্টার লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ। মোশাররফ হোসেন ও তাঁর সাথীরাও আক্রমণের প্রতিরোধ শুরু করলেন সর্বশক্তি দিয়ে।এক পর্যায়ে মোশাররফ হোসেন লক্ষ্য করলেন বদিউল আলম ছাড়া তাদের অন্য সাথীরা সব নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।এরপর তিনি এবং তার সাথী বদিউল আলম শেল্টারের বাথরুমের জানালা ভেঙে পার্শ্ববর্তী ২৪ফুট উঁচু নালায় লাফিয়ে পড়েন।স্থানীয় মেথরদের সহযোগিতায় সেদিন তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।পরবর্তীতে ভারতে ফেরার পথে রামগড় চাপলাইশ্যা পাহাড়ে তিনি আবারও পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন।এদিনও পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে অনেক্ষণ যুদ্ধ হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৭ ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস চত্বরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।এ সময় সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমও উপস্থিত ছিলেন।যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস, বালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠসহ সকল প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে তখন তিনি ছিলেন সম্মুখ সারিতে । স্বাধীনতার পর তিনি নেমে পড়েন দেশ গড়ার কাজে ।হলেন রেলওয়ের প্রশাসক।

 

৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি তৎকালীন মোসতাক সরকারের প্রতিমন্ত্রী পটিয়ার নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় গিয়ে মোসতাকের মন্ত্রী সভা থেকে তাঁকে পদত্যাগের আহবান জানান এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে বলেন।পরে চট্টগ্রাম এসে নন্দনকাননের বাসায় বঙ্গবন্ধুর জন্য মিলাদের আয়োজন করেন। জিয়াউর রহমান যখন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তখনকার একটি ঘটনা।উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান জেলা পরিষদ মিলনায়তনে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা ডাকলেন ।সাবেক এমপিদেরও সভায় থাকতে বলা হলো।সাবেক অন্য এমপিদের সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন ।এক পর্যায়ে তাকে বক্তব্য দিতে বলা হলো।তিনি বক্তব্যের শুরুতেই জিয়াউর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন ” মেজর জিয়া যুদ্ধে আমি আর আপনি একসাথে যুদ্ধ করেছিলাম।যুদ্ধের সময় আমরা অস্ত্র দিয়ে ভেতরে লোক পাঠিয়েছিলাম দশজন রাজাকারকে হত্যা করার জন্য ।ভাগ্যক্রমে সেদিন অনেকে বেঁচে যায় । দুর্ভাগ্যজনক যে তাদের পাঁচ জন আজ সামনের সারিতে বসা।তখন উপস্থিত সবাই ফিসফিস করছিল মোশাররফ সাহেব কি বলে এসব!সেদিন তিনি বলেছিলেন আগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে হবে তারপর অন্য কাজ।”

অনেকেই মনে করেছিলেন তিনি সে রাতেই গ্রেফতার হবেন। এভাবেই তিনি সত্য উচ্চারণ করেছেন অকপটে মৃত্যু কিংবা জেল নিশ্চিত জেনেও।জিয়াউর রহমান কয়েক দফায় তাঁকে তাঁর মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন ।অনুরূপ অনুরোধ এরশাদ সাহেবেরও ছিল।তিনি দৃঢ়ভাবে দু’জনের অনুরোধই প্রত্যাখ্যান করেন ।১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম নিউমার্কেট চত্বরে তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিস্টার সুলতানের সামনে বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাঁর পায়ের রগ কেটে দেয়, কোমরে ছুরিকাঘাত করে।১৯৯২ সালে তিনি ফটিকছড়িতে শিবির সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ।১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারী কোতোয়ালির মোড়ে ট্রাকের উপড় পুলিশ তাঁকে বেধরক মারতে থাকেন।নেত্রীরও শত অনুরোধ পুলিশের কর্ণপাত হয়নি।এক পর্যায়ে তাঁকে মেরে আধমরা করে পাশের নালায় ফেলে দেয়া হয়।

ওয়ান ইলেভেনের সময় তাকে মিথ্যা অজুহাতে দেড় বছর কারাবরণ করতে হয়েছে ।১৯৮২সালে নেত্রীর দেশে ফেরার পর নেত্রীর নির্দেশে নতুন উদ্যমে তিনি দলকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। নেত্রীর সাথে তিনি চট্টগ্রাম- কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন । জিয়াউর রহমান যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিলেন তখন তাঁর নন্দনকাননের বাসাটি ছিল সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।৭০ থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৭বার এমপি হয়েছেন। ২ দফায় মন্ত্রী হয়েছেন ।৮৬’র সংসদে বিরোধী দলীয় হুইপ ছিলেন ।দুবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ১ম দফায় ডিসি হিল এবং ২য় বারে জাম্বুরী ও বায়েজীদ পার্কের বাস্তবায়ন করেন।

গত সরকারের সময় ঢাকার রমনা পার্কের সৌন্দর্যবৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেন। যা এখন বাস্তবায়নাধীন আছে।এজন্য অনেকে তাঁকে পার্ক পাগলও বলে থাকেন ।আসলেই মানুষটি শুধু পার্ক পাগলই নয় তিনি দেশ পাগল ও দল পাগল একজন মানুষ ।৭৫ পরবর্তীতে এবং ওয়ান ইলেভেনসহ দেশ এবং দলের সকল সংকটময় মুহূর্তে তিনি কখনও মাথা নোয়াননি অসত্যের কাছে।বিশেষ করে নেত্রীর অনুগত ছিলেন সবসময় ।নেত্রীর প্রশ্নে সদাসর্বদা ছিলেন আপোসহীন।নিজ নির্বাচনী এলাকা মীরসরাইর জন্যও যে তার কি টান গত সরকারের সময়কালে তার মীরসরাই সফর দেখেই বুঝা যায় ।এমন কোন শুক্র-শনিবার ছিলনা যেদিন তিনি মীরসরাই সফর করেননি ।

নিজ এলাকায় দলকে সংগঠিত করতে ৪৫৪টি পাড়া বৈঠক করেছেন ।আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটি গঠন করেছেন সম্মেলন করে।তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ফজলুর রহমান স্কুল এণ্ড কলেজ এর চিত্র দেখলেই বুঝা যায় শিক্ষার প্রতি তাঁর কেমন অনুরাগ।মনের সমস্ত আবেগ ও ইচ্ছা দিয়ে সাজিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানকে ।শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাস,উন্নত আবাসিক ব্যবস্থা, অবকাঠামোসহ সবকিছুর যোগান রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে এ প্রতিষ্ঠানে ।তাঁর প্রতিষ্ঠিত এস রহমান ট্রাস্ট সমাজ কল্যাণসহ এখানকার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সাহায্য করছে।

মীরসরাইতে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন।এখানে ২০ লাখেরও অধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে।মহামায়া মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন তাঁর জীবনের অনন্য পাওয়া। বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এ প্রকল্পের সূচনা করতে চেয়েছিলেন ।তাঁরই কন্যার হাত ধরে তিনি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।জীবন সন্ধ্যায় এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন ।তাঁর যুদ্ধের সাথীরা দেরিতে হলেও তাঁর এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে আনন্দিত ।আজ সমাজে শিষ্টাচার ও নীতি নৈতিকতার আকাল চলছে।একদিন কিছু সংস্কৃতিকর্মী আসলেন তাদের একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি করার জন্য ।ডিসি হিলেই অনুষ্ঠানটি হবে।ডিসি হিল যেহেতু তাঁরই করা তাই এর মাধ্যমে তাঁর প্রতি সংস্কৃতিকর্মীদের কিছুটা কৃতজ্ঞতা জানানো।তিনি জিজ্ঞেস করলেন অনুষ্ঠানে আর কে থাকবেন? তাঁরা বললেন প্রফেসর খালেদ সাহেব বিশেষ অতিথি থাকবেন ।তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন না না আমি বিশেষ অতিথি থাকবো, প্রফেসর খালেদ সাহেব প্রধান অতিথি থাকবেন । তিনি আমার গুরুজন। প্রফেসর খালেদ সাহেবকে প্রধান অতিথি করেই তাঁরা নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন ।অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রফেসর খালেদ সাহেবকে নিজ গাড়ি করে এনায়েত বাজার তাঁর গন্তব্যে নামিয়ে দিলেন।এ ঘটনায় বুঝা যায় তার শিষ্টাচার ও নৈতিকতার দৃঢ়তা যা আজ বর্তমান নেতা কর্মীদের নেই বললেই চলে।আজ আমরা অপরকে যে কোনভাবে ডিঙিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় মত্ত আছি। এ নিরহঙ্কার দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের আজ ৭৮তম জন্মদিন ।এ শুভদিনে এ সুন্দর মানুষটির জন্য অফুরান শুভকামনা ।